নজরুল: নারী প্রসঙ্গে।

0

সাম্যের গান গাই ৷
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো-
                 ভেদাভেদ নাই ৷
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি
                        চির-কল্যাণ কর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী
                          অর্ধেক তার নর ৷
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ তাপ
                        বেদনা অশ্রুবারী
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর,
                       অর্ধেক তার নারী ৷
----------------------------------

         মহিলাদের সম্পর্কে কাজী নজরুলের ধারণা অত্যন্ত ষ্পষ্ট ৷ তিনি যে সাম্যের কবি সে কথা বহুবার বহুভাবে প্রকাশ করেছেন ৷ তিনি বললেন—" সাম্যের গান গাই৷
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো       ়                     ভেদাভেদ নাই ৷ "
তিনি নারী জাতি সম্বন্ধে হঠাৎ করে এমন মন্তব্য করলেন কেন ?

              তিনি যেহেতু সাম্যের কবি এবং মানবতার কবি সেহেতু নারী জাতির দুঃখ-দুর্দশা তার চোখ এড়িয়ে যায়নি ৷ সাধারণভাবে আমরা যা জানি কবি নজরুল আমাদের তুলনায় বহু বিষয়ে অনেক বেশী জ্ঞান রাখতেন ৷ তাহলে নারী সমাজের দুর্গতি সম্পর্কেও তিনি অনেক বেশী অবশ্যই জানতেন ৷ মানবজাতির ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যাবে যে, পৃথিবীতে সব দেশে সব যুগে নারী জাতির জীবন খুব সুখের নয় ৷
প্রাচীন যুগে আমাদের ভারতে নারী জাতির দুর্দশা অবর্ণনীয় ৷ আমাদের ভারতের সাধারণ লোকেরা শুধু নয় ধর্মীয় পণ্ডিতগণ ও নারী জাতিকে    অ-কারণে ভীষণভাবে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখতেন ৷
(a) মনুস্মৃতি ধর্মগ্রন্থে লিখিতভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে - "নারী মাত্রেই শূদ্রাণী ৷ "
(b) নারী জন্মগতভাবে কুস্বভাবের হয় এবং নারীকে বিশ্বাস করা যায় না বা নারী বিশ্বাসের অযোগ্য ৷
(c) পুরুষদের জন্য চতুরাশ্রমের ব্যবস্থা ছিল কিন্তু নারী জাতির জন্য কোন আশ্রম নেই যেমন- ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ, বানপ্রস্থ ও সন্যাস ৷
(d) নারী জাতির জন্য শিক্ষা শূদ্রদের  মতই একেবারে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ৷
(e) পুরুষদের জাতব্যবস্থা বাঁচিয়ে রাখার জন্য, কোন মহিলার স্বামী মৃত হলে ঐ মৃত স্বামীর চিতায় জীবন্ত মহিলাকে সতিপ্রথার নামে পুড়িয়ে মারা হত ৷
(f) দেবদাসীর নামে নারী জাতিকে মন্দিরে মন্দিরে শত শত বালিকা- দেরকে পুরোহিতদের ভোগের সামগ্রী হিসাবে ব্যবহার করা হত ৷
(g) গুরুপ্রসাদী প্রথার নামে বিবাহের প্রথম রাত্রে নববধূকে স্বামীর সঙ্গে নয় পুরোহিতের সঙ্গে রাত্রী যাপন করতে হত ৷
       এছাড়াও বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ, কৌলিন্য প্ৰথার নামে ব্রাহ্মণ পুরুষদের শতাধিক বিবাহ ছাড়া ও আরো কত কি সব নিয়ম, প্রথা সবই নারী সমাজকে  শোষণ করার জন্য ধর্মের নামে তৈরী করা হয়েছিল ৷

           ঐ সময়ে আরব দেশে হজরত মুহাম্মদের আবির্ভাবের পূর্বে  নারী জাতির বিরুদ্ধে বহু কুপ্রথা প্রচলিত ছিল ৷ যেমন-
(1) পুরুষদের একাধিক নয় বরং ডজনের অধিক বিবাহের প্রচলন ছিল  (2) শিশু কন্যাকে জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই গলা টিপে অথবা মাটি চাপা দিয়ে হত্যা করা হত ৷
(3) গরু ছাগলের মত মহিলাদেরকেও ক্রীতদাস হিসাবে বাজারে হাতে পায়ে দড়ী পরিয়ে ক্রয়-বিক্রয় করা হত ৷
(4) গরু ছাগলের মত মেয়েদেরকেও রাস্তা থেকে ছিনতাই বা চুরী করে তুলে নিয়ে যাওয়া হত ৷
(5) পুরুষদের মত মহিলারাও পাইকারীহারে মদ্যপান করত ৷
(6) পুরুষদের মত মহিলারাও একাধিক বা ডজনের অধিক স্বামীসহ বিবাহিত জীবন যাপন করত ৷

          এছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য  দেশের মহিলারাও নানা রকমের কুপ্রথা বা নানা আইন কানুনের মাধ্যমে শোষিত ও নির্যাতিত হত ৷  এই বিষয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লিখিত "নারীর মূল্য" বইটিতে বিভিন্ন দেশের মহিলাদের উপর বিভিন্ন প্রকারের অত্যাচার-নির্যাতনের বিস্তারিত বিবরণী লিপিবদ্ধ করা আছে ৷ আবার কোন কোন দেশে বা কোনো কোনো ধর্মমতে নারী জাতিকে   "নরকের কীট" বা "নরকের দ্বার "  বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে ৷
বর্তমান পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যদেশ হিসাবে পরিচিত বিলাত বা ইংল্যণ্ডে 1920 এর দশক পর্যন্ত নারী জাতিকে পুরুষের সমান ভোটাধিকার দিতে অস্বীকার করা হয়েছিল ৷ কারণ ঐ সভ্য (?) ইংরেজ জাতির দৃষ্টিতে নারীরা পুরুষদের সমান হওয়ার যোগ্য নয় ৷

                 এখন আমরা আমাদের জন্মভূমী ভারতের বর্তমান অবস্থায় নারী সমাজের হাল-হকীকত নিয়ে আলোচনা করছি ৷ খাতা কলমে বলা হচ্ছে যে আমরা ভারতীয় জনগণ 1947 সালে স্বাধীনতা লাভ করেছি ৷ নিশ্চয় পুরুষদের সাথে সাথে মহিলারাও স্বাধীনতা লাভ করেছে ৷ বর্তমান স্বাধীন ভারতের সংবিধানে নারী সমাজের জন্য ও সম্মান, মর্যাদা, অধিকার এবং সুযোগ সুবিধার কথা মৌলিক অধিকার হিসাবে লিখিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ বলা হয়েছে — ভারতের কোন নাগরিকের সঙ্গে জাতিভেদ, ধর্মভেদ, বর্ণভেদ, ভাষাভেদ ও লিঙ্গভেদ কোন ব্যপারেই কারো সঙ্গে কোনরূপ ভেদাভেদ বা পক্ষপাতিত্ব  করা চলবেনা ৷ কিন্তু একটু চোখ কান খোলা রাখলেই জানা যাবে যে, আমাদের বর্তমান স্বাধীন ভারতে মহিলারা কোন অবস্থাতেই ভালো নেই ৷ রেডিও, টিভি, পত্র-পত্রিকা, সোশাল সাইট খুললেই আপনার চোখে পড়বে নারী-সংক্রান্ত দুঃখজনক সংবাদ ৷ যেমন— নারীর শ্লীলতাহানী, নারীর অপমান, নারী ধর্ষণ, গণধর্ষণ, নারী পাচার, বধুহত্যা, যৌতুক বাবদ নারীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে অগ্নি সংযোগ, নারীর অপমান-লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, মুসলমান সমাজে তালাকের বা 3 তালাকের অপপ্রয়োগ, নারীর আত্মহত্যা, পণপ্রথা, অসহায় নারীর দেহ ব্যবসা প্রভৃতি অবর্ণনীয় ঘটনা দৈনিক অব্যাহত গতিতে বা অবাধে ঘটে চলেছে ৷ কবে যে এর শেষ হবে সে কথা ভবিষ্যতবাণী করার মত লোক বা সময় এখনও আসেনি ৷ দিল্লীতে একটিমাত্র "নির্ভয়াকাণ্ড" শুধু নয় দৈনিক শত-শত, হাজার-হাজার অসহায় মহিলা পরনির্ভশীল হয়ে অনেকে আত্মহত্যা করে বসে বা বিভিন্নভাবে লজ্জাজনক জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে ৷ তার প্রতিকার কি ? এই দুরারোগ্য রোগের আশু সমাধান কি ? আজ হিন্দু-মুসলমান-খৃষ্টান-শিখ, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ,ধনী-গরীব নির্বিশেষে যে কোন মহিলাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে স্বাধীন ভারতে আপনি একজন মহিলা হিসাবে কেমন আছেন ? তার উত্তরে তিনি কি তাঁর আত্মসন্তুষ্টি প্রকাশ করে জোর গলায় বলতে পারবেন যে "স্বাধীনতার পূর্বের থেকে এখন অনেক অনেক ভালো আছি ৷ মোটেই না, কখনই না ৷ তাহলে আমাদের মেয়েদের উদ্ধারের জন্য আমরা কি করতে পারি ? আমরা কিভাবে আমাদের মা-বোনেদের সম্মান-মর্যাদা বাঁচিয়ে তাদের মর্যাদাকে সমুন্নত ও প্রতিষ্ঠা  করতে পারি  ৷ এখন তো আর ইসলামের কোন নবী-রসুল আসবেন না ৷ তাহলে আমরা কি আমাদের মেয়েদেরকে একথা বলতে পারি যে , হে মহিলা সমাজের সদস্যাগণ ? আমরা আপনাদের জন্য বহু দিন থেকে বহু চেষ্টা-সাধনা করেছি এখন আমরা অপারগ, আমরা অসহায় ! আমরা আপনাদের মর্যাদা রক্ষায় চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ ৷ অতএব আপনারা আপনাদের নিজেদেরকে দেখে নিন বা বুঝে নিন ৷ একথা বলাটা কতটা শোভনীয় হবে ? বরং পণ্ডিতদের মতে একটা দেশের উন্নতি অবনতির মানদণ্ড হল সেই দেশের মহিলারা কেমন আছেন ? সেই দেশের সংখ্যালঘুরা কেমন আছেন ? আমরা ভারতীয় পুরুষরা ঐ দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের 2 টি তেই ডাহা ফেল হয়ে বসে আছি ৷

            উপরোক্ত আলোচনা থেকে যেটা অনুভব করা গেল তা হল এই যে, কবি নজরুল ইসলাম যেভাবে ঘোষণা করেছিলেন — "সম্যের গান গাই, আমার চোখে পুরুষ-রমণী কোন ভেদাভেদ নাই ৷ বিশ্বে যা কিছু মহান চির কল্যাণকর -------৷ " তাঁর মতে এই পৃথিবীতে যা কিছু মহান, কল্যাণকর তা শুধু পুরুষের একার চেষ্টাতেই নয় বরং বিশ্বে যত কিছু ভাল বা মন্দ সব কিছুই কেবলমাত্র পুরুষরাই করেনি বা সব কিছু শুধুমাত্র নারীরাই করেনি ৷ যত ভালো কাজ এবং যত মন্দ কাজ আজ পর্যন্ত হয়েছে সমস্ত কাজই নারী পুরুষ মিলেই হয়েছে ৷ তাহলে আমরা সর্বব্যপারে শুধুমাত্র নারী জাতিকেই দোষারোপ করব কেন ? ব্রাহ্মণ পণ্ডিত মনুর মতে নারী বিশ্বাসের অযোগ্য, পুরুষরা কি  ধোয়া তুলসীপাতা ? বোধহয় এইজন্যই কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর লিখেছেন- "এসো ব্রাহ্মণ শুচি করি মন ধর হাত সবাকার ৷" কবি রবীন্দ্রনাথ নিজে ছিলেন ব্রাহ্মণ তাই তিনি চিনেছিলেন যে ব্রাহ্মণদের মনটাই হল অপবিত্র ৷ আমাদের সমাজে প্রতিদিন কত প্রকারের অন্যায় কাজ, বেআইনী কাজ, অপরাধমূলক কাজ ঘটেই চলেছে তার মধ্যে শতকরা  10 %  অন্যায় কাজও মহিলারা করতে পারেনা ৷ তাহলে শুধু শুধুই মহিলা জাতিকে দোষারোপ করা হয় কেন ? যেমন— মদ্যপান করা, জুয়া খেলা, চুরী করা, জোচ্চোরী করা, ঠগবাজী করা, শঠতা-ভণ্ডামী করা, ন্যায়ের অভিনয়ে অন্যায় কাজ করা, ডাকাতী করা, ছিনতাই করা, রক্তপাত করা, মানুষ খুন করা, জলদস্যু-বিমান হাইজ্যাক করা, মিথ্যাসাক্ষী বা মিথ্যাকেস দিয়ে নিরপরাধ প্রতিবেশীকে পেরেশান করা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে বহু নারী পুরুষকে হত্যা করা, রাজনৈতিক খুন-খারাবী করা, নির্বাচনে বুথ দখল করা, বোমা-পিস্তল নিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে বেআইনী কাজ বা চোরাচালানের কাজ করা ৷ এতগুলো যা যা উল্লেখ করা হল এর মধ্যে মহিলারা  5 % ও অপরাধমূলক কাজ করতে পারবেনা ৷ সমস্ত অপরাধমূলক কাজই পুরুষরা করে থাকে আর মহিলারা অসহায় ও দুর্বল বলে সমস্ত দোষ তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়াটা ও এক প্রকার স্বার্থপরতার পরিচয় ৷

                আমার মতে মহিলারা যদি সত্য-সত্যই মান, সম্মান, অধিকার নিয়ে সুনাগরিক হিসাবে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাহলে তাদেরকেও কিছুটা দায়িত্ব নিতে হবে বা যোগ্যতা তৈরী করতে হবে ৷ প্রতিটি মহিলা যদি শিক্ষা বা উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে, ইংরাজী শিক্ষায় পারদর্শী হয়, ধর্মীয় শিক্ষাসহ সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন-কানুন, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, কম্পিউটার, বক্তৃতা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা প্রভৃতি জ্ঞানমূলক বিষয়ের প্রতি অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে উন্নত বিবেক ও উন্নত চরিত্র অর্জন করতে পারে তাহলে সততাপূর্ণ, ন্যায়পরায়ণ ও উদার মানসিকতা সম্পন্ন পুরুষদের সহযোগিতায় একদিন না একদিন আমাদের নারী সমাজ আত্মপ্রতিষ্ঠায় সফল হবে এ ব্যপারে আমি নিশ্চিত ৷ এইভাবে মহিলা সমাজের প্রতি কবি নজরুলের উচ্চধারণা বাস্তবে প্রতিষ্ঠা হতে পারে ৷

Shared by: Robiur

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)