ভারতের ভবিষ্যত কোন পথে ? By: Zakariya Molla

0

   আমাদের দেশের নাম ভারত৷ ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় যে, আমাদের ভারতের একদিকে যেমন গৌরবোজ্জল ইতিহাস পাওয়া যায়,  অন্যদিকে আবার ভারতের দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত  যন্ত্রণাক্লিষ্ট ও অমানবিক এবং অত্যাচারের নিষ্ঠুর ইতিহাস ও পাওয়া যায়৷ বর্তমান ভারতে  নানা রকমের সমস্যা ও অস্থিরতা বিরাজ করছে৷ আমরা মূল ভারতীয়রা আজ নিজ দেশে পরবাসীর মত জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছি৷ আমরা সকলেই জানি যে আমাদের দেশে সম্পদের অভাব নেই৷ ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে আরো জানা যায় যে, প্রাচীন কাল থেকে আমাদের ভারত সম্পদে পরিপূর্ণ৷ বহু উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে 1947 সালে আমরা নাম সর্বস্ব স্বাধীনতা লাভ করেছি৷ আমাদের ভারতের শাসন প্রণালী অনুসারে আমরা গণতাণ্ত্রিক শাসন কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত স্বাধীন দেশের নাগরিক৷ আমাদের দেশের সংবিধান বিশ্বশ্রেষ্ঠ সংবিধান হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে৷ আমাদের দেশের সংবিধানে নাগরিকদের জন্য কি কি অধিকার লিপিবদ্ধ করা আছে তা দেশের মোট  জনসংখ্যার 10 %  মানুষ ও অবগত নয়, এ কথাটি আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি৷ আমি অসংখ্য শিক্ষিত মানুষদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার সুযোগ লাভ করেছি৷ ফলে জানতে পেরেছি যে,  অধিকাংশ উচ্চশিক্ষিত মানুষরা রাজনীতি বা রাষ্ট্র পরিচালনা সংক্রান্ত  (political Science) বিষয়ে  উৎসাহী বা আগ্রহী নয়৷ তারা এক কথায় উত্তর দেয় যে " আমরা রাজনীতি বিষয়টি ভালো বুঝতে পারিনা৷" আমার ধারণা এই ছিদ্র দিয়েই বেহুলা-লখিন্দরের দুর্ঘটনার কাহিনীর মত " বিষাক্ত সর্পটি প্রবেশ করে এবং দংশন করে৷ " অর্থাৎ আমাদের দেশের অর্ধেক লোক অশিক্ষিত, আর শিক্ষিতদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আগ্রহী নয়৷ ফলে যে 2/4 জন লোক কষ্ট করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা রাজনীতি পড়ে বুঝতে পারে, সেই কয়েকজনই রাজনীতিতে মাতব্বরী করে এবং করছে৷  ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য যে, ঐ কটি লোকই হয় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বংশোদ্ভুত৷ ভোটারদের মধ্যে 85 % জনগণ আমরা, আর প্রতিটি নির্বাচনে হৈ হৈ করে বিজয়ী তারা হয় যারা মাত্র 15 % জনগণ৷ ব্যপারটি  অবশ্যই গবেষণার বিষয়৷

         ★★    ভারতের সংবিধানের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি হল— সাম্য, মৈত্রী  স্বাধীনতা, শিক্ষা, শোষণ থেকে মুক্তি, ন্যায়, ধর্মীয় স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সুবিচার, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ জনমত গঠনের অধিকার৷

        ★★★    উপরোক্ত বিষয়গুলো এক একটির ওজন কয়েক কুইন্টাল বা কয়েক টন হবে৷ ভারতের সংবিধান পৃথিবী শ্রেষ্ঠ সংবিধান তার কারণ, ঐ সমস্ত বিষয়গুলো উল্লেখ আছে বলেই৷ আসল কথা হল, প্রাচীন ভারত থেকে আধুনিক ভারত পর্যন্ত আমাদের দেশে রাজত্বের আসনে 5000 বছর ধরে সমাসীন হয়ে আছে বিদেশী ব্রাহ্মণ সন্তান আর্যরা৷ তাদের মাথা, মন- মস্তিষ্ক অসাম্য ভিত্তিক চিন্তাধারায় পরিপুষ্ট বেদ, গীতা, মনুস্মৃতির কুপ্রভাবে প্রভাবিত হয়ে মনুবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ, জাতপাত, ভেদাভেদ, উঁচুনিচু, বড়ছোট ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্রসহ দুলে, বাগদী, ডোম, ক্যাওরা, সুঁড়ি, সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা, মুচি, মেথর, মাহিষ্য, সৎচাষী, কামার, কুমোর প্রভৃতি জাতের নামে বজ্জাতি মার্কা চিন্তা-ভাবনা বদ্ধমূল হয়ে আছে৷ জ্ঞান, বিজ্ঞান, ইতিহাস, নৈতিকতা, সততা, ক্ষমা, উদারতা, সহিষ্ণুতা প্রভৃতি গুণাবলী  মনুবাদী বা ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজে একদম অপরিচিত৷

       ★★★     আমাদের দেশের সংবিধানে যে 6 টি মৌলিক অধিকারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে বিগত 70 বছরে  তার একটিও কার্যকর হয়নি৷ যেমন— (1) সাম্যের অধিকার, (2) স্বাধীনতার অধিকার, (3) ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার, (4) শিক্ষা ও সংস্কৃতির অধিকার (5) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার এবং  (6) শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার৷

         ★★★     স্বাধীন ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং উপরোক্ত মৌলিক অধিকারগুলো এবং বিগত 5000 ( পাঁচ হাজার) বছরের অসহায়, নির্যাতিত, শূদ্র, অস্পৃশ্য, শ্রমিক শ্রেণী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু তথা নারী সমাজ ও মূলনিবাসীদের অধিকার সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং  সুপ্রিমকোর্ট দ্বারা ঐ অধিকারগুলো কার্যকর করার নিশ্চয়তা প্রদান করার কারণেই ভারতের সংবিধান বিশ্বশ্রেষ্ঠ সংবিধান হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে৷ শুধু তাই নয় বরং যে সমস্ত কোটি কোটি মানুষদেরকে জাতপাত ও বর্ণবাদের কবলে নিক্ষিপ্ত করে মানবাধিকার বঞ্চিত করে পশুর মত জীবন যাপনে বাধ্য করা হয়েছিল তাদের জন্য বাবাসাহেব আম্বেদকর ভারতের সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাগতভবে সংরক্ষণের (reservation)  মাধ্যমে উন্নয়ণের পাকাপাকি ব্যবস্থা করে  গেছেন৷ তিনি One man one value,  one man one vote এই নীতিতে সকল নাগরিকের হাতে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা তুলে দিয়ে গেছেন৷ সেইজন্য ডঃ আম্বেদকরের লিখিত সংবিধান পৃথিবী শ্রেষ্ঠ সংবিধান হিসাবে পরিগণিত হয়েছে৷

      ★★★    আমি আমার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক সীমিত কর্মতৎপরতার  অভিজ্ঞতায় জানতে সক্ষম হয়েছি যে, ভারতে 15 %  সংখ্যালঘু উচ্চবর্ণ ব্যতীত নিম্নবর্ণ বা Sc, St, Obc, Minorities তথা শূদ্র-অস্পৃশ্য-আদিবাসী ও মুসলমানরা তাদের নিজেদের স্বার্থে সংবিধানে বর্ণিত সাধারণ অধিকার ও মৌলিক অধিকার কোন বিষয়ে অবগত ও উৎসাহিত নয়৷ ফলে আধুনিক ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, বৈজ্ঞানিক ও আধুনিক কম্পিউটার যুগে বসবাস করে, সমস্ত রকমের সযোগ-সুবিধা থাকা সত্তেও বহু বিষয়ে জ্ঞানলাভ করার করার পরও আমরা ভারতের 85 % জনগণ আমাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় নি৷ এটা আমাদের শিক্ষিত ও অসহায় মানুষদের দুর্ভাগ্য এবং চরম ব্যর্থতা৷ গণতণ্ত্রের দৌলতে প্রতি 5বছর অন্তর আমরা যে ভোটাধিকার প্রয়োগ করি তাও আমরা শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করতে সক্ষম হইনি৷ আমাদের চিরশত্রু ব্রাহ্মণরা প্রতিটি নির্বাচনে অজ্ঞতা ও দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে আমাদের ভোটগুলো অর্থের লোভ দেখিয়ে সমস্ত ভোট লুট করে নেয়৷  আর আমরা বোকার মত, অবিবেচকের মত, রাজতাণ্ত্রিক দেশের অসহায় জনগণের মত নিরুপায় ও ভীতু-কাপুরুষের মত অনুগত ও আদর্শ ক্রীতদাসের মত মুখ, ঠোঁট, জিহ্বা বন্ধ করে কেউ আল্লাহর রহমতের আশায়, কেউ ঈশ্বরের আরাধনায় আত্মনিয়োগ করি৷ এইভাবে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের কঠিন  আন্দোলনের ফলে প্রাপ্ত ভোটাধিকার  নিজ হস্তে অপাত্রে দান করে নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই ডেকে আনছি৷

        ★★★★★   তাহলে আমাদের দেশের ভবিষ্যত কোন পথে ? আমি মনে করি যে, আমরা অর্থাৎ ভারতের মূলনিবাসী জনগণ ( Sc, St, Obc & Minorities) তফসিলি জাতি, তফসিলি উপজাতি ও অনগ্রসর শূদ্র জাতি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলমান, খৃষ্টান, শিখ, বৌদ্ধ ও জৈন৷ আমরা যদি আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পালন করি এবং ইতিহাসের শিক্ষা অনুযায়ী বিদেশী ব্রাহ্মণদেরকে শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করি, নির্বাচনের সময় ব্রাহ্মণদেরকে ভোট না দিই তাহলে মাত্র 15 % উচ্চবর্ণরা ভোটযুদ্ধে অবশ্যই পরাজিত হবে৷ আর গণতাণ্ত্রিক পদ্ধতিতে আমরা যদি  85 % মূলনিবাসীরা ঐক্যবদ্ধভাবে, সংগঠিত হয়ে রাজনৈতিক ময়দানে অবতীর্ণ হই তাহলে সর্বাবস্থায় আমরাই বিজয়ী হব৷ আমরা আমাদের দেশকে পরিচালনা করব৷ আমাদের অসহায় জাতির লোকজনের উন্নয়ণ ঘটাব৷ আমাদের সম্মান, মর্যাদা, ক্ষমতা, সমান সুযোগ, সমান অধিকার সব কিছুকে আমরা আমাদের প্রতিনিধিত্ব, আমাদের উপস্থিতি স্থাপন করতে পারব৷ আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও প্রচার বিভাগ সব জায়গায় আমরা পৌঁছতে সক্ষম হব৷ মণ্ডল কমিশন ও সাতার কমিশনের সুপারিশকে কার্যকর করতে পারব৷ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ করতে পারব৷  ব্রাহ্মণ্যবাদীদেরকে সব জায়গা থেকে হটিয়ে দিয়ে proportionally representation বা সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারব৷ মূলনিবাসী রাজ কায়েম করে মূলনিবাসীদের অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হব৷ আমরা যদি উপরোক্ত কাজগুলো করি তাহলে আমাদের দেশের ভবিষ্যত উজ্জ্বল হবে একথা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলা যায়৷

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)