ইসলামে তালাক ও তিন তালাক৷

0



★ ইসলামী সমাজে তালাক (স্বামী স্ত্রীর বিচ্ছেদ, divorce) ব্যবস্থা কোরআন ও হাদীসের দ্বারা স্বীকৃত৷ কোরআন এবং হাদীসের মাধ্যমে একথাটিও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তালাক ইসলামে একটি অপছন্দনীয় শেষ ব্যবস্থা হিসাবে অনুমতি দেওয়া হয়েছে মাত্র৷ কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে আমরা লক্ষ্য করছি যে, মুসলমান পুরুষরা তালাকের সঠিক ব্যবহার না করে বরং তালাকের অপব্যবহার বা অপপ্রয়োগ করে চলেছে৷ এর ফলে তালাকের অপব্যবহারের কুফল মুসলমান মহিলাদেরকে ভোগ করতে হচ্ছে৷ তিন (3) তালাকপ্রাপ্তা মহিলাদের সমস্যাটিকে এমনভাবে সমাধান করা হয় যেটি অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক, অসামাজিক এবং কোরআন-হাদীসের পরিপন্থী, অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং লজ্জাজনক হিসাবে চিহ্নিত হয়৷ এই কারণে তালাক ব্যবস্থার পক্ষে এবং বিপক্ষে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন রকমের মতামত ব্যক্ত করতে বাধ্য হচ্ছে৷ আরো লক্ষ্য করলে জানা যায় যে, মুসলমান সমাজে অজ্ঞ, অশিক্ষিতদের মধ্যে শুধু নয় বরং ইসলামিক পণ্ডিতদের মধ্যে ও তালাক এবং তিন (3) তালাকের নিয়ম-পদ্ধতি, বিধিব্যবস্থা নিয়ে নানারকম বিভ্রান্তি ও নানা মুনির নানা মত পরিলক্ষিত হয়৷

★★ আমি দৃঢ়তার সঙ্গে অবগত করাতে চাই যে, মুসলমানরা কোরআন শরীফ পাঠে আগ্রহী নয়৷ যদি কেউ পাঠ করে সেও বুঝবার উদ্দেশ্যে নয় বরং অধিকাংশ মুসলমানই কোরআন আরবী ভাষায় পাঠ করে নেকী বা পুণ্য লাভের উদ্দেশ্যে৷ জ্ঞান অর্জনের জন্য নয়, হেদায়েত বা উপদেশ গ্রহণের জন্য নয়, আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে নিজের জীবন পরিচালিত করবো, এই উদ্দেশ্যে ও নয়৷ মুসলমান সমাজে অধিকাংশ শিক্ষিত জনগণ কোরআন শরীফকে পাঠযোগ্য পুস্তক হিসাবে মান্য করতে আন্তরিকভাবে রাজী নয়৷ একশত (100) জন শিক্ষিত মুসলমান নারী বা পুরুষের মধ্যে মাত্র 5 জন আরবীসহ মাতৃভাষায় কোরআন শরীফের তরজমার দৈনিক পাঠক পাওয়া অতি দুষ্কর৷ শুধু তাই নয় বরং মুসলমান সমাজে মওলানা-মৌলুবীদের দ্বারা একথা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে প্রচারিত হয়ে আছে যে প্রবিত্র কোরআন মাতৃভাষায় বুঝেসুঝে তরজমা পাঠের থেকে না বুঝে আরবী ভাষায় পাঠ করা অতীব নেকীর কাজ৷ এ ব্যপারে মওলানাদের আচরণ ঠিক ব্রাহ্মণদের মত৷ ব্রাহ্মণরা শূদ্রদেরকে তাদের ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করতে দেয় না, পাঠ করা দূরের কথা৷ আর মৌলুবীরা স্পর্শ করতে দেয়, আরবীতে পাঠ (তেলাওয়াত) করতে দেয় কিন্তু অনুবাদ পাঠ করে বুঝতে নিরুৎসাহ করে৷ প্রকৃত ব্যপার হল, মুসলমান সমাজে যারা একটু ধর্ম কর্মে উৎসাহি তাদের মধ্যে অধিকাংশই মাতৃভাষা পর্যন্ত জানেনা৷ আবার যারা স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটীর ছাত্র/ছাত্রী তাদের মধ্যে অধিকাংশই ধর্ম কর্মে নিরুৎসাহী অথবা ধর্মবিরোধী মানসিকতা সম্পন্ন৷ ফলে তথাকথিত ধর্মীয় নেতারা মুসলমান সমাজের অশিক্ষিত ও নিরক্ষরদেরকে অজ্ঞতার সুযোগে পরকাল, আখেরাত, কবরের আযাবের ভয় দেখিয়ে ধর্মীয়ভাবে শাসন ও অর্থনৈতিক শোষণ করে চলেছে সেই একনায়কতণ্ত্রী বাদশাহ মুয়াবিয়ার রাজত্বকাল থেকেই৷ বর্তমান ভারতের তথাকথিত ধর্মীয় পণ্ডিত বা আলেমগণ রাজনীতি সম্পর্কে কোন সুষ্পষ্ট ধারণাই রাখেনা৷ কেবলমাত্র ধর্মের নামেই তারা নেতৃত্ব করছে, সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক শোষণ ও করছে৷ অজ্ঞ মুসলমান তো দূরের কথা, এমনকি উচ্চশিক্ষিত মুসলমানরাও আলেমদের মোকাবেলায় কোন প্রতিকার করতে অপারগ৷ কারণ, উচ্চশিক্ষিত মুসলমান মানেই হল ইসলামী বিষয়ে ভীষণভাবে অনভিজ্ঞ৷ সেই জন্য মওলানা-মৌলুবীদের পোয়াবারো৷ এখানে মুসলমান মহিলারা একান্তভাবেই অসহায়৷

★★★ মুসলমান সমাজে তালাক ব্যবস্থা আছে এবং এটা থাকারও প্রয়োজন আছে৷ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি মতবৈষম্য ঘটে এবং যদি উভয়ের শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে, তা যদি বিভিন্ন উপায়ে সমাধান করা সম্ভব না হয় তখন তালাকই হল মহিলাদের আত্মরক্ষার সর্বশেষ ব্যবস্থা৷ ইসলামে তালাককে একটি অত্যন্ত অপছন্দনীয় শেষ ব্যবস্থা হিসাবে গণ্য করা হয়েছে৷ কোরআন শরীফে সূরা তালাকের 1 নং আয়াতে বলা হয়েছে
یا ایہا النبی اذا طلقتم النساء فطلقو ھن ،،،،،،،،، ـ "

অর্থাৎ হে নবী, তোমরা স্ত্রীদের তালাক দিলে তাদেরকে ইদ্দতের জন্য তালাক দাও৷ এবং ইদ্দতের সময়টা ঠিক মত গণনা কর৷ আর তোমাদের রব আল্লাহকে ভয় কর৷ (ইদ্দত পালনের সময়ে) তোমরা তাদেরকে তোমাদের বাড়ী থেকে বের করে দিওনা৷ তারা নিজেরাও যেন বের না হয়৷ তবে তারা যদি স্পষ্ট অশ্লীল কাজ করে তবে ভিন্ন কথা৷ এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা৷ যে আল্লাহর সীমাসমূহ লঙ্ঘন করবে, সে নিজেই নিজের উপর জুলুম করবে৷ তোমরা জানোনা, আল্লাহ হয়ত এর পরে সমঝোতার কোন উপায় সৃষ্টি করে দেবেন৷

" সূরা নিসার 34 নং আয়াতে বলা হয়েছে যে—
الرجال قوٰمون علی النساء بما فضل اللہ بعضھم علی بعض، ،،،،،،،،،،، ـ
" অর্থাৎ পুরুষ নারীর অভিভাবক৷ এ জন্য যে, আল্লাহ তাদের একজনকে অন্যজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন৷........................
আর যে সব স্ত্রীর ব্যপারে তোমরা অবাধ্যতার আশঙ্কা কর , তাদেরকে বুঝাও, শয়নগৃহে তাদের থেকে আলাদা থাকো এবং তাদেরকে মারধোর কর৷.....................
তাহলে পুরুষের আত্মীয়দের মধ্য থেকে একজন সালিশ ও স্ত্রীর আত্মীয়দের মধ্য থেকে একজন সালিশ নির্ধারণ করে দাও৷ তারা দুজন সংশোধন করে নিতে চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসা ও মিলমিশের পরিবেশ সৃষ্টি করে দেবেন৷ আল্লাহ সব কিছু জানেন, তিনি সর্বজ্ঞ৷

★★★ উপরোক্ত কোরআন শরীফের দুইটি বা আরো কয়েকটি আয়াতে এবং এই সম্পর্কিত বহু হাদিসে তালাক সম্পর্কে যে সমস্ত বর্ণনা পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে একথা বলা যায় যে, তালাক এক সঙ্গে তিন বার নয়৷ এক সঙ্গে 3 তালাক প্রদান করা কোরআন ও হাদীস সম্মত নয়৷ এরপরও আলেমদের চোখের সম্মুখে মুসলমান সমাজে 3 তালাক বেশ রমরমিয়ে চলছে৷ যেখানে কোরআন বলছে যে, তালাক প্রদানের পর স্ত্রীকে নিজ বাড়ী থেকে বিদায় করা যাবেনা৷ সেখানে আলেম সমাজ বলছে তালাকের পর স্ত্রী স্বামীর বাড়ীতে বা স্বামীর চোখের সামনে অবস্থান করবেনা৷ এখানে লক্ষ্যনীয় যে, আলেমরাই কোরআনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে৷ এরদ্বারা প্রমাণিত হয় যে আমাদের আলেম সমাজ কোরআন ও হাদীসের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে এবং মুসলমান সমাজকে বোঝাতেও ব্যর্থ হয়েছে৷ এরপর আছে বিভিন্ন মজহাবি মতভেদ৷ এমনিতেই মুসলমানরা অশিক্ষিত, তারপর শিক্ষিতরাও কোরআন পাঠ করেনা, তরজমাও পাঠ করেনা৷ ধর্মীয় জলসা বা ধর্মীয় সভাগুলোতে তালাক সংক্রান্ত আলোচনা কখনও শোনা যায় না৷ কারণ অধিকাংশ মওলানা সাহেবগণই তালাকের সুস্পষ্ট বিধান সম্পর্কে অনভিজ্ঞ৷ তারপর মুসলমানদের মধ্যে যারা যত পরিমাণে শিক্ষা থেকে, সভ্যতা থেকে, ধর্মীয় পরিবেশ থেকে দূরে অবস্থান করে, তাদের মধ্যে তত অধিক পরিমাণে তালাকের প্রবণতা দৃষ্টিগোচর হয়৷ ফলে অজ্ঞ মানুষদের পরিবারে কেউ ক্রোধবশতঃ তালাক প্রয়োগ করলে সে আর এক (1) তালাক বা দুই (2) তালাকে সীমাবদ্ধ না থেকে তিন (3) তালাক দিয়েই তবে সে ক্ষান্ত হয়৷ তখন সেই অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ছোট মওলানা, মেজ মওলানা ও বড় মওলানা সাহেবগণ কিছু অর্থমূল্যের বিনিময়ে যে ফতওয়া দেন সেটা হল অঘোষিত জিনা বা ব্যভিচারের সমতুল্য৷ এই জুলুম থেকে মুসলমান সমাজকে বিশেষ করে মুসলমান মহিলা সমাজকে উদ্ধারের পথ কি ? এটা কি কোন পুরুষ মুসলমানের ভাবনা-চিন্তা করা নাজায়েয ? যদি জায়েয থাকে তাহলে কোন মুসলমান পুরুষ ভাবছেনা কেন ? ব্রাহ্মণ পণ্ডিত রামমোহন রায় তথাকথিত হিন্দু মহিলাদেরকে সতীদাহ থেকে মুক্তি দেওয়ার লক্ষ্যে যে আন্দোলন পরিচালনা করে শাসক ইংরেজদেরকে প্রভাবিত করে মহিলাদেরকে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন, বর্তমান মুসলমান সমাজে তদ্রুপ অন্ততঃ 1 জন পুরুষকে প্রয়োজন৷ যিনি বর্তমান মুসলমান মহিলাদেরকে তালাকের অপব্যবহারের জুলুম থেকে মুক্তি দিতে পারবেন৷ এই মহান ও জনকল্যাণমূলক কর্মে ইসলামী পণ্ডিত মওলানা-মওলুবীগণ যদি সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করেন সেটাও ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে৷ কিন্তু ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে যে এই মহান সংস্কারের কাজে ধর্মীয় নেতা বা মওলানা, মওলুবীরা সহযোগিতা করবেনা৷ ব্যতিক্রমী কোন মহান পুরুষকে পাওয়া গেলে মহিলারা তাকে মহান পুরুষ হিসাবে অবশ্যই গণ্য করবে এবং নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান হিসাবে বিবেচনা করবে৷ তবে এরকম একটি সংস্কার আন্দোলনে মহিলাদেরও অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরী৷ আমি শিক্ষিতা মহিলাদেরকে প্রস্তুত হওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি৷

★★★★ সর্বশেষে বলতে চাই যে, ইসলামে তালাক ব্যবস্থা নারী সমাজকে নির্যাতন করার উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত হয়নি৷ বরং নারী সমাজকে পারিবারিক অশান্তির অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্ষার জন্যই প্রবর্তিত হয়েছে৷ এর বিপরীতে আমরা দৈনিক পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লক্ষ্য করি যে, ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ ব্যবস্থায়, যেখানে তালাকের (স্বামী স্ত্রীর বিচ্ছেদ, divorce) সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই সেখানে দাম্পত্য কলহের কুফল হল, পতি দেবতারা স্বহস্তে নিজ স্ত্রীর দেহে অগ্নি সংযোগ করে জীবন্ত দগ্ধ করে অসংখ্য নারীদেরকে হত্যা করে চলেছে৷ আর ঐ সমাজে নারীরা যতই উচ্চশিক্ষিতা হোক, নিঃশব্দে, চুপিসারে, অসহায়ের মত উচ্চশিক্ষিত পতি দেবতার হস্তে, জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে অগ্নিদগ্ধ হয়ে চিরবিদায় নিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হতে বাধ্য হচ্ছে৷ এটা শিক্ষিত তথা সমাজ সচেতন মানুষদের জন্য অত্যন্ত দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাগ্যের বিষয়৷ মুসলমান মহিলারা আজও জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে পরিত্রাণ পেয়ে যাচ্ছে৷ তার কারণ হল মুসলমান সমাজে তালাক ব্যবস্থা৷ আমি জ্ঞানতঃ তালাক ব্যবস্থাকে কোনভাবেই মহিমামণ্ডিত করছিনা৷ বরং যেটা বাস্তব সেটাই বলতে চেয়েছি৷ কেউ যদি বিষয়টির গভীরে গিয়ে হৃদয় দিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে সে অবশ্যই অনুধাবন করতে সক্ষম হবে৷


Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)