★ يا ايها الذين آمنو اطيع الله واطيع ارسول و اللامر منكم ـ قرآن ـ سوره نساء ـ آية 59 ــــ
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন যে —
" হে ঈমানদার জনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রসুলের আনুগত্য কর আর সামগ্রিক দায়িত্ব সম্পন্ন আমীরের ( নেতার) আনুগত্য কর৷
কোরআন, সুরা- নিসা, আয়াত নং 59
★ কোরআনে উল্লিখিত নির্দেশ গুলোকে আমরা যদি গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে স্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে পারব যে, ইসলাম প্রকৃত প্রস্তাবে অন্যান্য ধর্মের মত শুধুমাত্র ধর্ম নয় বা শুধু বিশ্বাসই নই বরং ইসলাম হল একটি জীবন ব্যবস্থা৷ ইসলাম একটি সাংগঠনিক ব্যবস্থামূলক ধর্ম৷ ইসলামের শিক্ষা হল, প্রতিটি মুসলমানকে আল্লাহর নির্দেশ মানতে হবে তারপর নবীর নির্দেশ মানতে হবে তারপর সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতার নির্দেশ মানতে হবে৷ তবেই সে একজন পরিপূর্ণ মুসলমান৷
★ সেই জন্য ইসলামে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, ইবাদত বন্দেগীর সঙ্গে সঙ্গে একটা সাংগঠনিক রূপ দেওয়া হযেছে৷ অর্থাৎ ইসলাম হল একটি সংগঠন৷ এর সর্বোচ্চ নেতৃত্বে ছিলেন নবী মুহাম্মদ (সঃ) নিজে৷ ইসলামের আছে কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদ, আছে বিভিন্ন রাজ্য ভিত্তিক উপদেষ্টা পরিষদ এবং আছে বিভিন্ন আঞ্চলিক শাখা সংগঠন৷ এইভাবে ইসলাম তার সমস্ত জনগণকে বা প্রতিটি ব্যক্তিকে, সর্ব নিম্ন থেকে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সম্পন্ন মানুষকে সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়৷ 5 ওয়াক্তের নামাজ, সাপ্তাহিক জুম্মা, বাৎসরিক হজ, ঈদ ও বকরাঈদ, কোরবানী সবই এর অন্তর্ভুক্ত৷ যেন প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তিগতভাবে অথবা সমষ্টিগতভাবে তার সংগঠনের সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রের মধ্যে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মান্য করতে এবং তার নিকট জওয়াবদিহি করতে বাধ্য হয়৷ একজন মুসলিম, তার ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ব্যবসা-বাণিজ্য, আত্মীয়তা, লেন-দেন, ইবাদত-বন্দেগী, বিবাহ-তালাক, সন্তান লালন পালন, ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, সমাজে ন্যায়মূলক কর্মের প্রসার, অন্যায়মূলক কর্মের প্রতিরোধ, রাজনীতি, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, নীতি, সুনীতি, দুর্নীতি, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন, গরীব, ফকীর, মিসকীন, বৃদ্ধ, বিধবা, অসুস্থ, নারী, শিশু ও অসহায় মানবজাতির কল্যাণে ইসলাম বা প্রতিটি মুসলিম সদা সক্রিয় থাকবে৷ এটাই হল পরিপূর্ণ ইসলাম৷
★ নবী মুহাম্মদ ( সঃ) এর; জীবদ্দশায় এবং নবীজীর ইন্তেকালের পর এইভাবেই ইসলাম একটি ধর্ম ও সংগঠন হিসাবে বজায় ছিল৷ নবীজীর পর হজরত আবু বকর, হজরত উমর, হজরত উসমান ও হজরত আলী ( রাজিঃ আনহুম) পর্যন্ত 4 জন খলীফা এইভাবেই ইসলাম ধর্মের ইবাদত বন্দেগী + সামাজিক ব্যবস্থা নিজেরা মান্য করে চলতেন এবং সকলকে পরিচালনা করতেন৷ পরবর্তীকালে বা বর্তমানে লক্ষ্য করা যায় যে, ইসলাম আছে, ধর্ম আছে কিন্তু সংগঠন নেই, ইসলাম আছে কিন্তু নেতৃত্ব নেই৷ কারণ 4 জন খলীফার পর হজরত মুয়াবিয়া ও বিপথগামী এজীদের মত বিভ্রান্ত ও নীতিভ্রষ্ট লোক ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল৷ তারা ইমাম হাসান ও হোসাইনকে, ইমাম জয়নুল আবেদীনকে (রাজিঃ) এবং ইমাম আবু হানিফাকে হত্যা করেছিল শুধুমাত্র রাজতাণ্ত্রিক ব্যবস্থায় বংশগত রাজত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য৷ ফল হল এই যে, বাহ্যিক ইসলাম রইল, নামাজ, রোজা, দাড়ী, টুপী সবই ছিল বা এখনও আছে কিন্তু ইসলামী শিক্ষা, ইসলামী চরিত্র, ইসলামী সমাজব্যবস্থা, ইসলামী চেতনা, ইসলামী মূল্যবোধ, ইসলামী ধ্যান-ধারণা কোন কিছুই নেই৷ বর্তমানে মুসলমানদের কাছে ইসলামও নেই ইসলামী শিক্ষাও নেই বা ঈমানদার মুসলমানদের হাতে কিছুই নেই তখন নাম সর্বস্ব ইসলাম রয়ে গেল, যেটা এখনও আমরা দেখতে পাচ্ছি৷ কবি নজরুল এসব দেখে বললেন—
" সব আছে তবু শবের মত ভাগাড়ে পড়িয়া কেন ? "
★ তারপর ঘটেছে কারবালা, তারপর সৃষ্টি হল বিভিন্ন মজহাব, তারপর সৃষ্টি হল বিভিন্ন জামাত, বিভিন্ন ইমাম, বিভিন্ন মসলক, বিভিন্ন তরীকা, বিভিন্ন মত ও পথ৷ বড় পীর, ছোট পীর, পাঁচ পীর, পাক পাঞ্জাতন প্রভৃতি৷ ইসলামের মৌলনীতি ছিল যে, যেখানে কোরআন নেই, যেখানে হাদীস নেই সেখানে ইসলামও নেই৷ কিন্তু পরবর্তীকালে যা ঘটল সেটাকে বুঝতে গেলে বলতে হয়, রামকৃষ্ণ হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে বলেছেন " যত মত, তত পথ৷ " এখন আমাদের মুসলমানদের অবস্থা হল— আলেম, পীর, মওলানা, মৌলুবী, আউলিয়া, বোজর্গ, পীরে কামেল, মাশায়েখ, মাজার, মৃত অথচ জীবন্ত পীর, ওয়ায়েজীন, বক্তা, যে যা বলেন কোন যাঁচাই না করে সেই মজহাব, সেই মসলক, বা তরীকাকে মুসলমানরা মান্য করতে বাধ্য হচ্ছে৷ এখন মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের সামান্যতম জ্ঞান এবং গুণ নেই অথচ আমরা সবাই নিজেদেরকে ভাবছি খাঁটী মুসলমান৷ ঈমান থাক বা না থাক, ঈমানী গুণ থাক বা না থাক, ঈমানী চেতনা থাক বা না থাক তবু আমরা খাঁটী (?) মুসলমান৷ কাজী নজরুল ইসলাম হয়ত বড় পীরসাহেব ছিলেন, তাই তিনি বহু দিন পূর্বেই বুঝতে পেরেছিলেন যেটা আজকের প্রতিষ্ঠিত বড় বড় পীরসাহেবরা ও বুঝতে পারেন নি৷ কবি বলেছেন—
" দলে দলে চলে কলের পুতুল শক্তি শৌর্যহীন,
নাহিক ঈমান বলিতে হইবে ইহারা মুসলেমীন৷ "
বড়পীর কবি নজরুল আরো বলেছেন—
" ভিতরের দিকে যত মরিয়াছি বাহিরের দিকে তত,
গুণতিতে মোরা বাড়িয়া চলেছি গরু-ছাগলের মত৷ "
★ অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হল এই যে, মুসলমানদের ধর্মীয় জলসা-মীলাদ-ওয়াজ-নসীহতে আলেমগণ বা বক্তাগণ নামাজের আলোচনা যত বেশী করেন তার অর্ধেকও জাকাতের বিষযে বা লেখাপড়ার বিষয়ে এবং শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষা বা ইংরাজী শিক্ষার বিষয়ে বা কোন সামাজিক সমস্যার বিষয়ে আলোচনা করেন না, এর কারণ কি ?
★ এখন নন মুসলিমরা বা ইসলামের বিরোধীরা ইসলামের বিরুদ্ধে যা বলছে মুসলমানরা ও তাই বলছে৷ এখন নন মুসলিমদের মধ্যে কেউ কেউ ইসলাম কিছুটা জানে কিন্তু মুসলমানরা যে একদমও ইসলাম জানেনা, এর সমাধান কি ? অশিক্ষিত মুসলমান লোকেরা সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ মওলানা-মৌলুবীদের নিকট থেকে যেটা শুনে সেটাকেই তারা ইসলাম মনে করে৷ আর English educated মুসলমানদের মধ্যে সিংহভাগ ইসলামের ( অ আ ক খ ) জানেনা৷ এক কথায় মুসলমান জনগণ শিক্ষিত বা অশিক্ষিত কেউই সঠিক ইসলামকে জানেনা৷ শুধু এইটুকুই নয়, সমস্ত মুসলমানদেরকে লেখাপড়া শেখানো বা সকলকে ইসলামের মৌলিক শিক্ষাটুকু শেখানোর কোন ব্যবস্থা আমাদের মুসলমান সমাজের আলেম-পীর-বোজর্গরাও করেনি আর আধুনিক শিক্ষিতরা তো ধর্মীয় শিক্ষার বিরোধী৷ এমতাবস্থায়, সমস্ত মুসলমানরা সমস্ত মজহাব, সব জামাত, সব তরীকার লোকেরা নিজ নিজ গোষ্ঠীভুক্ত ইসলাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে৷ এদের কাছে নবীর জীবন, নবীর হাদীস, কোরআনের নির্দেশ বা কোরআনের বর্ণনার থেকে পীরেদের, বা মৌলুূবীদের কথার মূল্য অধিক৷ এখানে সংগঠন নেই, নেতা নেই, নেতৃত্ব নেই, আদর্শ নেই, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-পরিকল্পনা কোন কিছুই নেই৷ সেই জন্য আজ এত আলেম, পীর, বোজর্গ, মওলানাদের বাড়বাড়ন্ত৷ ইসলামী চেতনা বহির্ভূত, ইসলামী পদ্ধতি বহির্ভূত কুসংস্কার, দুর্নীতি ও বাপদাদাদের অন্ধ অনুসরণের দাপাদাপী৷ শবেবরাত মানেই হল দুম দুম করে বোমা ফাটানো আর রোজা মানে হল ভালো করে জমকে ইফতার অনুষ্ঠান করানো৷
★ আমি মুসলমান সমাজের মধ্যে যারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তাদেরকে বিষয়টি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার অনুরোধ করছি৷ কারণ— ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত আলেমগণ বর্তমান পৃথিবীর হাল-হকীকত জানেন না, তাই তারা অপারগ৷